তখন আমার বয়স সম্ভবত পাঁচ বছর। বোরহানউদ্দিন থানার গঙ্গাপুর ইউনিয়নের ধারিয়া গ্রামে আমার জন্ম। আমি অজ-পাড়া গাঁয়ের ছেলে, ইস্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। তবে বাড়ির দরজার মক্তবে আলিফ- বা- তা- সা- পড়া শুরু করেছি। আমার চাচাতো ভাই আলী আকবর মাওলানা আমাদেরকে আরবী পড়াতেন।
দিন, তারিখ, মাস আমার মনে নেই। তবে বছরটি যে ১৯৭১, সে কথাটি ভাল মনে আছে। আমাদের গ্রামের বাড়ির পশ্চিম পাশে ছিল গঙ্গা নদী। একদিন দুপুরে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর একটা গানবোট আকস্মিকভাবে গ্রামবাসীর উপর নির্বিচারে গুলি করতে করতে যাচ্ছিলো। তখন আমরা সবাই বাড়ির পূর্বপাশে মাটির ঢিবির পিছনে আশ্রয় নিয়েছিলাম। অনেক গ্রামবাসি সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং মৃত্যুবরণও করেছে! এ কথা আজো আমার মনে আছে।
সে সময় দেখতাম, আমার বড় ভাইসহ অন্যান্য যুবকেরা বিকেল বেলা একত্রিত হয়ে ধান ক্ষেতের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতো। ক্রলিং করতো, লেফট রাইট, লেফট রাইট করতো। লেফট রাইট শব্দটি বাংলা নাকি ইংরেজী সেটা আমি জানতামনা। কিন্তু তখন থেকেই এই শব্দটির সাথে আমার পরিচয়। আমি একা একা যখন হাঁটাতাম তখন নিজে নিজেই মাঝে মধ্যে লেফট রাইট-লেফট রাইট করতাম, আবার মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আবার ক্রলিং করারও চেস্টা করতাম।
একদিন দেখছি আমার মা অনেক কান্না-কাটি করছেন! মায়ের কান্না দেখে মায়ের সাথে আমিও কেঁদেছি। সেদিন বড় ভাইয়ের বন্ধুরা এসে মাকে শান্তনা দিয়ে বল্লেন চাচী আম্মা, আপনি কাঁদবেন না। মিন্টুকে ওরা একটি ফুলের টোক্কাও দিতে পারবেনা। তা’হলে আমরা সবকিছু জ্বালিয়ে দিবো এবং কঠিন প্রতিশোধ নিবো। পরে বুঝতে পারলাম যে রাজাকার এবং পাকিস্তানি হায়েনারা আমার ভাইকে আটক করে নির্যাতন করছে! কিন্তু ভাইয়ের বন্ধুরা তাদের কথা রেখেছে এবং আমার ভাইকে হায়েনাদের কাছ থেকে উদ্বার করেছে এনেছে। বড়ভাই ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন।
আমার বড় ভাই হযরত আলী মিন্টু মাতাব্বর সবেমাত্র ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য পড়া-লেখা বন্ধ করে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করলেন। এরপর রক্ষী বাহিনীতে যোগদান এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানি স্বাক্ষরতিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’র সেই পুরনো সার্টিফিকেটি আজো আমাদের ঘরে ফ্রেমে বাঁধাই করা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও স্বাধীনতার ৫০ বছরে পূর্তিতেও হযরত আলী মিন্টু মাতাব্বর সহ আরো অনেকে সরকারি তালিকা ভুক্ত মুক্তিযাদ্ধা হতে পারেননি! কিন্তু তাতে তাদের কোন আফসোস নেই! কারণ তারা যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য। এটাই তাঁদের আত্মতৃপ্তি।
মোহাম্মাদ আবদুল মতিন
সম্পাদক
বিদেশ বাংলা টোয়েন্টিফোর ডট কম
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
০১/০৩/২০২১