মৎস্যচাষিরা বলছেন, অনেকেই পুকুরে আগের মতো এককভাবে রুই, কাতলা, মৃগেল জাতের দেশি মাছ চাষ করেন না। কারণ, দেশি মাছ বড় হতে সময় বেশি লাগে। এ ছাড়া এককভাবেও এসব মাছের চাষ লাভজনক নয়। সে জন্য পাঙাশ, ট্যাংরা, কই প্রভৃতি মাছের বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত) হিসেবে পুকুরে দেশি মাছের চাষ হচ্ছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মৎস্য চাষ) মো. খালেদ কনক এর কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০ বছর আগে হাওর, বিল, খালের মতো উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের বিচরণস্থল সমৃদ্ধ ছিল। এখন উন্মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ কমেছে। যা আছে, তাতে পলি জমে গভীরতা কমে যাচ্ছে। এতে আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া উন্মুক্ত জলাশয়ে দূষণ ও দখল বেড়েছে। এসব কারণে রুই, কাতলা, মৃগেলের মতো দেশি মাছের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
পাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছ সহজপ্রাপ্য প্রোটিন (আমিষ) হওয়ায় বাজারে চাহিদা বেশি। এ ছাড়া রুই–কাতলার তুলনায় তেলাপিয়া ও পাঙাশ দ্রুত বাড়ে। অল্প জায়গায় বেশি চাষ ও বেশি লাভ হওয়ায় চাষিরা এসব মাছ চাষে ঝুঁকছেন। এ কারণে তেলাপিয়া ও পাঙাশের উৎপাদন বেড়েছে বলে মনে করেন খালেদ কনক।
ফিরে দেখা: তেলাপিয়া, পাঙাশ, রুই, কাতলা
তেলাপিয়া আফ্রিকান মাছ। ১৯৫৪ সালে শহরের পয়োনালার মশা নিধনের জন্য তেলাপিয়ার মোজাম্বিক জাতটি দেশে আনা হয় বলে জানান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নব্বইয়ের দশকে ফিলিপাইনে তেলাপিয়ার আটটি জাতের ওপর গবেষণা করা হয়। সেখানে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে তেলাপিয়া গিফট নামের একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়। সেটি ওই দশকেই বাংলাদেশে আনা হয়। এ জাতই বাংলাদেশের বাজারে প্রভাব বিস্তার করছে।
মাহফুজুল হক বলেন, দেশে তেলাপিয়ার ফিলিপাইনের জাত জনপ্রিয়। এটি প্রচুর খায়, বাড়েও বেশি। দামে সস্তা হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ এ মাছ বেশি কেনেন। তাঁদের আমিষের বড় উৎস এ জাতের তেলাপিয়া।
অপর দিকে পাঙাশ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া অঞ্চলের মাছ। বর্তমান বাজারে প্রচলিত পাঙাশের জাতটি থাইল্যান্ড থেকে দেশে আনে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। নব্বইয়ের দশকে থাইল্যান্ড থেকে আনা পাঙাশ মাছটি থাই পাঙাশ নামে পরিচিত।
অধ্যাপক মাহফুজুল হক বলেন, বর্তমান বাজারে যে পাঙাশ পাওয়া যায়, সেটি থাই পাঙাশ। বাংলাদেশেরও নিজস্ব জাতের পাঙাশ আছে। জাতটি পদ্মাসহ দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে পাওয়া যায়। দেশি জাতটি খুবই ভালো। কিন্তু এ জাতের কৃত্রিম প্রজনন বা পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হয়নি। থাই পাঙাশের পোনা উৎপাদন করায় এটি বাজারে প্রভাব বিস্তার করেছে।
মাহফুজুল হক আরও বলেন, রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালবাউশ বাংলাদেশি মাছ। পুকুরে এসব মাছেরও উৎপাদন বেড়েছে। তবে তেলাপিয়া-পাঙাশের তুলনায় কম।
রুই-কাতলার অবদান কমছে
২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণ মাছ উৎপাদন (সমুদ্র ছাড়া) হয়, তার মধ্যে রুই ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ ও কাতলা ৯ শতাংশের বেশি। ২০২০-২১ অর্থ বছরে দেশের মোট মাছ উৎপাদনে রুইয়ের অবদান কমে হয় ১১ শতাংশের কিছু বেশি ও কাতলা হয় প্রায় ৭ শতাংশ।
অন্যদিকে ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট মাছের মধ্যে পাঙাশ ছিল ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ ও তেলাপিয়া ৫ শতাংশের কিছু বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঙাশের অবদান বেড়ে ১০ দশমিক ২১ শতাংশ হয়েছে। আর তেলাপিয়ার প্রায় ১০ শতাংশ।
পারিবারিকভাবে মৎস্য পেশায় যুক্ত ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার রাজাবাড়ী গ্রামের শ্রীবাস দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একসময় পুকুরে রুই, কাতলাসহ দেশি মাছের চাষ করতেন তাঁরা। কিন্তু ১০-১২ বছর ধরে পুকুরে এককভাবে দেশি মাছ চাষ ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, শুধু দেশি মাছ চাষ করে লাভবান হওয়া যাচ্ছে না।
বর্তমানে পাঁচটি পুকুরে মাছ চাষ করছেন শ্রীবাস দাস। এর মধ্যে তিনটিতে পাঙাশ, একটিতে গুলসা ও আরেকটিতে ট্যাংরা চাষ করছেন। এই পাঁচটি পুকুরেই বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত) হিসেবে তেলাপিয়া, রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ রয়েছে।
শ্রীবাস দাস বলেন, সাধারণত ৫ থেকে ৬ মাসে ৩০-৩৫টি পাঙাশ মাছে এক মণ ওজন হয়। একই সময়ে তিনটি তেলাপিয়ায় এক কেজি হয়। অন্যদিকে এ সময়ে এক কেজি হতে রুই-কাতলা লাগে চার থেকে পাঁচটি। পাঙাশ-তেলাপিয়ার তুলনায় রুই-কাতলার বৃদ্ধি কম হয়।
উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে মাছের দাম
সামগ্রিকভাবে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে (সমুদ্র ছাড়া) মাছের উৎপাদন ছিল প্রায় ২৭ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ লাখ মেট্রিক টনে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১১ সালে প্রতি কেজি রুইয়ের গড় দাম ছিল ২৭৫ টাকা। সেখানে ২০২০ সালে দাম হয় ৩২০ টাকা। ১০ বছরে রুইয়ের দাম কেজিতে ৪৫ টাকা বেড়েছে। অপর দিকে ২০১২ সালে পাঙাশের দাম ছিল প্রতি কেজি ৯৬ টাকা। ২০২০ সালে দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১১৭ টাকা। ৯ বছরে পাঙাশের গড় দাম বেড়েছে ২১ টাকা।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ছোট আকারের প্রতি কেজি রুই বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়, মাঝারি ৩৬০ ও বড় আকারের ৫৫০ টাকায়। কাতলা বিক্রি হচ্ছিল ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। এ ছাড়া প্রতি কেজি পাঙাশ বিক্রি হয় ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় ও তেলাপিয়া ২২০ থেকে ২৫০ টাকা।
বাজারটির মাছ বিক্রেতা হজরত শাহ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মাছের দাম এক বছর ধরেই বাড়ছে। মাসখানেক হলো আরও বেড়েছে। পাঙাশ–তেলাপিয়া গরিব মানুষ খেত। এসবের দাম বেড়ে গেছে। অনেকের পক্ষেই এখন মাছ খাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।